ব্লগে শব্দের ও ভাষাগত সচেতনতা

ভাষাগত আঞ্চলিকতা, বিভিন্নভাষার অপিরমিত ব্যাবহার, প্রযুক্তিগত সংক্ষেপিত ভাষা আর নিজস্বতা সব কিছু মিলিয়ে এখন বাংলা ভাষা একটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। কলকাতার বাংলা, বাংলাদেশের বাংলা, টেলিভিশনের বাংলা, এফএম রেডিওর বাংলা আর তথ্যপ্রযুক্তির বাংলা নিয়ে অনেকগুলো শব্দ নিয়ে দ্বিধাদ্বনদে পরে যান অনেকে। বাংলা সাহিত্যে বাংলা একরকম দেখা যায় আর বাংলা ব্লগে এসে প্রযুক্তি সচেতনদের বাংলা ভাষার ব্যবহারের নানামূখিতা বর্তমান সমাজের ভাষার ব্যবহারে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারনা করা যায়।

আমার ভাষা জ্ঞান কম থাকলেও বাংলা ব্লগে ও সামাজিক নেটওয়ার্কে ভাষাগত বেশ কিছু জিনিসকে আমি সহ্য করতে পারি না। এমনও হতে পারে যে আমার লেখার মধ্যে বেশ কিছু ভাষাগত গোড়ামী অনেকে সহ্য করতে পারেন না। এই পোষ্টটি মূলতঃ বাংলা ব্লগারদের জন্য অন্যান্য ভাষায় ব্লগ লেখকদেরও কাজে লাগতে পারে। আমি কাউকে ভাষা ব্যবহারের বেপারে বধ্য হতে বলবো না, বলবো না আমি যা বলছি তাই আপনাকে মানতে হবে। কারন মাতৃভাষা প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার-সেটা আঞ্চলিক ও দুর্বোধ্য ভাষাও হতে পারে, সেই ভাষার লিখিত রূপ নাও থাকতে পারে। তবে বাংলা ব্লগারদের উচিৎ মৌলিক বাংলাভাষাকে বিভিন্নমূখী বিকৃতি থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে। আর এ জন্য কিছু কিছু বিষয়ে নিজেকে সচেতন করে নিতেও পারেন।

১. আঞ্চলিকতা

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সহ অনেক ব্যক্তিত্ব আঞ্চলিকভাষাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এখন অবশ্য আঞ্চলিকভাষার প্রতি তেমন মায়া মমতার আত্নপ্রকাশ দেখতে পাই না। বেশ কিছু দিন আগে গ্রামে গিয়ে আমি নিজে গ্রামের আঞ্চলিক টান দিয়ে কথা বলতে চেষ্টা কলেও অনেককে দেখলাম শুদ্ধ বাংলা ভাষার কথাবলা চেষ্টা করছেন। এই বেপারটা অনেকের কাছে ভাল হতে পারে, অনেকের কাছে আঞ্চলিক ভাষা বজায় রাখার পক্ষপাতি হতেও পারে।

নতুন কোন সভ্যতার দিকে এগিয়ে আসলে মানুষের মধ্যে দুই ধরনের সভ্যতার মিশ্রণ দেখা যায়। আমি এই মিশ্রণটি অনেক সময় সংশয় ও ঝামেলা সৃষ্টির কারন হতে পারে।

ব্লগে যারা লিখছেন তারা একটা সভ্য সমাজের প্রতিনিধি বলে ধরে নেওয়া যায় (কারন, তাদের প্রায় ১০০% শিক্ষিত , প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শি ও তথ্য সচেতন)। আর ব্লগারদের ভাষাগত আঞ্চলিক টান থাকা আমি একদম পছন্দ করি না। ব্লগটি সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হবে নতুবা শুদ্ধ বাংলায় লিখতে অনুরোধ করবো। মতামতের বেলায় একই কথা বলবো।

আঞ্চলিকভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধে বলছি না, তবে এটা মিশ্রিত ব্যবহার অনেক সময় পাঠকদের কাছে দুবোর্ধ্য লাগতে পারে। আর আঞ্চলিক ভাষা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার আলাদা ব্লগ বানানো যেতে পারে যেখানে সবাই যারা যার আঞ্চলিক ভাষার কথা বলবে।

২. ইংরেজী ভাষার মিশ্রণ

আঞ্চলিকতা

ইদানিং বাংলার সাথে ইরেজী শব্দ মিশিয়ে কথা বলে অনেকেই বেশ মজা পায়। এটা অবশ্য মানতে হবে যে, বেশ কিছু ইরেজী শব্দ বলে মজা পাওয়া যায় কারন মনের ভাবটি পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে গেলে কিছু কিছু সময় বাংলা শব্দটা দিয়ে করা সম্ভব হয় না। এটা ঠিক যে, সুপ্রভাত বা শুভ রাত্রী বলার চেয়ে Good Morning, Good Night বলা সহজ। এটা মানছি যে, প্রযুক্তির অনেক কিছুরই বাংলা শব্দ নেই, তাই আমাদের ইংরেজী বলতেই হবে। তবে ইদানিং এফএম রেডিও গুলোর ভাষা বিপর্যয়ে আমি বেশ ব্যাথিত। একটু দ্রুত গতিতে কথা বলতে গিয়ে বাংলাভাষায় অহেতুক টান দেওয়া, বিনা প্রয়োজনে ইংরেজী শব্দ এনে বলা এবং ভাবের গভীরতার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কথা বলা শুনছি- রেডিওগুলোতে।

কিন্তু যেখানে বাংলা বলা যাবে সেখানে অহেতুক অন্য ভাষাকে সাথে নিয়ে কথা বলা গেলেও ব্লগে অত্যাধিক ব্যবহারকে আমি অপছন্দ করি। বেশ কিছু ইংরেজী শব্দ কথায় ও চ্যাটিং এ ব্যবহার করলেও ব্লগে সেইভাবে যাতে প্রকাশ করা না হয় এটাই সবার প্রতি আমার অনুরোধ। বেশ কিছু ইরেজী শব্দ অনেকে বাংলা ভাষার মাঝে ব্যবহার করে যেমন- any way, by the way, Hi, Please, ok, bye, Great, Good job, Excellent, boss, loss খাওয়া, Crash করা, Time নাই,
ইত্যাদি। এই কথাগুলো বাংলা ভাষায় ইদানিং মিশেছে, এটা থামানো যাবে কিনা জানি না। তবে বাংলা ব্লগে এই শব্দগুলোকে মিশ্রিত করে প্রকাশ করা পছন্দ করি না।

৩. অভ্যাসগত শব্দ ও বাজে শব্দ

অনেকে কথার মাঝে বেশ কিছু শব্দ একটু বেশি ব্যবহার করেন। আর লিখিত বিষয়ের অবতারনা হলেও সেই অভ্যাস ত্যাগ করেন না। লেখকের নিস্বতার ক্ষেত্রে এটা অনেক সময় ভাল, আবার কিছু সময় এটা লেখকের খারপ দিক বলেও বিবেচিত হতে পারে। বেশ কিছু বাজে শব্দ আমরা হয়তো প্রত্যাহিক জীবনে ব্যবহার করি। সেই শব্দগুলোকে ব্লগে লিখলে বেমানানসই লাগবে।

আবার বেশ কিছু নতুন শব্দও রয়েছে যার অর্থের বেপারেও আছে নানান ধরনের ধারণা। এইসব শব্দ থেকেও সাবধান। এই  শব্দগুলোকে এক এক জন এক একভাবে দেখেন। তাই এই জাতীয় শব্দগুলোকে ব্যবহারের সময় বুঝিয়েও দেওয়া দরকার হতে পারে। ব্লগ ও মন্তব্যে বাজে শব্দ পরিহার করা উচিৎ।

কেন এই সচেতনতা?

১. ভাষাগত সৌন্দর্য পাঠক বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে। বানান ভুল এবং বাজে ও দুর্বোধ্য শব্দে ভরপুর লেখায় পাঠক আসতে ও পড়তে চাইবে না।

২. আপনি কি সবার সামনে সব কথা বলেন? নিশ্চই না। কিন্তু ব্লগে যে কথাটি লিখবেন সেটা সাবাই তো দেখবে ও পড়বে। বিভিন্ন শ্রেনীর, পেশার ও বয়সের পাঠক লেখাগুলো পড়বেন। আর তাই যা খুসি তাই লিখতে পারবেন না।

৩. বাংলা ভাষার স্ট্যান্ডার্ড বহায় রাখতে আমাদেরই দায়ীত্ব পালন করতে হবে। রক্ত দিয়ে কেনা ভাষার মর্যাদা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।

কমিউনিটি ব্লগে অবশ্য সব ধরনের সচেতনতা রক্ষা করে চলা সম্ভব হয় না। আবার বেশ কিছু ভাষা ব্লগ থেকেই উৎপক্তি হতে দেখছি। ব্লগে অনেকে আবেগত্বারিত হয়ে অনেক কিছুই বলে ফেলেন। মতাদর্শ আর চেতনার ভিন্নতার করানে এটা হতে পারে। কিন্তু আরো একটা জিনিসও খেয়াল করতে হবে যে, আমরা যা লিখি তা ভবিষ্যত প্রজন্ম সহ সবারই চোখে পড়বে, তাদের জন্য বিকৃত কিছু রেখে যাওয়া কি ঠিক?

9 thoughts on “ব্লগে শব্দের ও ভাষাগত সচেতনতা”

  1. রেডিও শুনলে হাসি পায়। আমিও একটা শব্দ প্রায়ই ব্যাবহার করি….. সুন্দর ভাষা মানুষের আরেকটি সৌন্দর্য… তবে সস্থানে আঞ্চচলিক ভাষাই উত্তম বলে মনে করি

    1. @ইমরান, স্ব-স্থানে আঞ্চলিক ভাষা আমিও পছন্দ করি। রেডিও’র লোকেরা হয়তো তাদের স্থানটার জন্য একটা নতুন আঞ্চলিকভাষা তৈরী করেছে। আর সেটাই তারা ব্যবহার করছে। তারা মনে করছে-সবাই তাদের আধুনিক ভাবছে। এদেরকে কি বলা যায়? “আধুনিক গোড়ামী” বললে কেমন হয়?

      অভিনেতাদের অনেকের কথার মেকিভাব আর ভংগি আমার কাছে বিরক্ত লাগে, অথচ সবচেয়ে মজার বেপার হলো এই জিনিসটাই অনেকে ভালবাসে… 😛

  2. আসলে এটা একটা বড় ব্যাপার। আমি কথায় কথা ইয়ে বলি দেখি আমার লেখাতেও ইয়ে চলে আসে। তবে, ব্লগে ব্যাবহার না করারই চেষ্টা করি।
    কিন্তু ফেজবুক কিংবা অন্য কোথাও এটা প্রচুর ব্যাবহার করি।

    1. @শিবলী, “বকবক করা”, “চিল্লাচিল্লি” ইত্যাদি শব্দগুলো ব্লগে দেখলে আমার বিরক্ত লাগে। নো মডারেশন ব্লগে আরো কত রকমের আজে বাজে কথা যে বলা হয় তার একটা তালিকা করা দরকার। তারপর সেইসব শব্দগুলোকে অটোমেটিক ডিটেক্ট করার ব্যবস্থা করা দরকার। এরকম একটা ওয়ার্ডপ্রেস প্লাগিনও আছে।

      1. @টিউটো, আমি আপনার ওপরের দুইটা শব্দয় ব্যাবহার করেছি! এখন থেকে সাবধান হতে হবে। আপনি লিস্ট শুরু করেন আমি আছি। অনেকের সাথে সাথে আমার অনেক কাজে লাগবে।

  3. এই টপিকের সাথ সামঞ্জস্য পূর্ণ আরো কিছু কথা বলা দরকার বলে মনে করি। তা হলো “আবেগপূর্ণ প্রকাশ ভঙ্গি”

    অধিকাংশ সময়ে আবেগপূর্ণ এবং বিতর্কিত বিষয়ে একচেটিয়া মনোভাবের প্রকাশটা একটু ভিন্নরকমের হয়। লেখক কিছু লোককে কোন একটি বিষয়ে ইনফ্লুয়েন্স করতে চায়। এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা যায় না এবং অনেক সময় অনেক সুন্দরতম সাহিত্যবোধও জন্ম নেয়। সেই সাথে কিছু কিছু অশ্লিল কথাও এসে যেতে পারে। অশ্লিল কোন বিষয়ে অশ্লিল শব্দ না ব্যবহার করে লেখার কৌশলটাও রপ্ত করার বেপার। কয়েকটা শব্দ বেশি ব্যবহার করে কৌশলে অশ্লিল শব্দটার ভাবার্থ প্রকাশ করা যায়।

    এখন কথা হলো- মূল কথাটা প্রকাশ করা গেল কিনা। মূল কথাটা বলতে গিয়ে শব্দ ব্যবহারের বিধি নিষেধের জন্য আটকে গেলেও সমস্যা। আমি শরৎ চন্দ্রের প্রায় সবগুলো উপন্যাসই পড়েছি, জীবনানন্দের প্রকাশিত কবিতার একটা কবিতাও বাদ দেই নি। সেখানে দেখেছি (যদিও শিখতে পারি নাই ) তারা কিভাবে নিজের মনের ভাব ও অসুন্দর বস্তুকে সুন্দর শব্দ দিয়ে ইঙ্গিত করেছেন। আবার খুব তুচ্ছ বস্তুকে অনেক সম্মানী করে তুলেছেন ভাষার প্রয়োগের মাধ্যমে।

    সাহিত্যবোধ আমার মধ্যে নাই, কিন্তু এ মূহুর্তে সাহিত্যকদের কাছ থেকে ভাষাগত অনেক কিছুই শিখতে মন চাইছে।

    জীবনানন্দ দাসের আমার প্রিয় একটি কবিতা… হায় চিল

    হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
    তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !
    তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে ।
    পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে ;
    আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ?
    কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদন জাগাতে ভালোবাসে !

    হায় চিল , সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
    তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !

    1. এত জটিল বিষয় আমদের মত বাচ্চারা বুঝতে পারবে না। তবে সাহিত্য রস আমিও আনার চেষ্টা করবো।
      চন্দ্র বাবুর শুধু পণ্ডিত মশাই পড়েছিলাম। তারপর আর পড়ার সাহস হয় নাই!

      1. @শিবলী, এজন্য অবশ্য প্রচুর বই পড়া দরকার। আমাদের অনেকেই কম্পিউটারে বসে থাকায় বই পড়ার সময়ও পায় না আবার ধর্য্যও হয় না। অথচ বাংলা সাহিত্যের পুরোটাই বইয়ে… ব্লগে খুবই সামান্য। ভাবছি আবার বই পড়ার অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনবো। বাজারে গিয়ে খুজে খুজে পছন্দের কিছু বই কিনতে হবে।

  4. Wow, wonderful blog layout! How long have you been blogging for? you made blogging look easy. The overall look of your site is fantastic, as well as the content!. Thanks For Your article about ব্লগে শব্দের ও ভাষাগত সচেতনতা | টিউটোরিয়ালবিডি .

Leave a Comment