এই ঘর এই লোকালয়”– শিল্প সুষমামন্ডিত কাব্য

এই ঘর এই লোকালয়

গ্রন্থ পর্যালোচনায় মিলি চৌধুরী

কবি  শফিকুল  ইসলাম  এক  জীবন বিদগ্ধ  চেতনার  কবি  । হৃদয়ের  টানাপোড়নের  কথামালা  তিনি অসাধারণ মমতা ও মেধায় তুলে  এনেছেন  তার  কাব্যগ্রন্থ  এই  ঘর  এই  লোকালয়’ এ। ২১শে বই  মেলায়  এর  প্রথম  প্রকাশ। ছোট  বড়  তেষট্টি  কবিতার সমাহার  ঘটেছে  এই  কাব্যগ্রন্থে। কাব্যগ্রন্থের  প্রথম  কবিতার  নামকরণেই  কবিতার  বইয়ের  নামকরণ। প্রতিটি  কবিতায়  নামকরণের  মাঝে নতুনত্ব  পাওয়া  যায়।

          এ গ্রন্থের  প্রায়  অধিকাংশ  কবিতাই  বিরহ  বেদনায়  ভারী  । কবির ভালোবাসার  জগতের  পুরো  অংশই না  পাবার  অথবা পেয়ে  হারাবার  কষ্টকে  গভীর  অভিমানে লালন করেছেন, যা  কবিতায়  তুলে  ধরতে  কবি  একটুও  দ্বিধাবোধ  করেননি। কবির  এই  সাহসী  উচ্চারণে  প্রতিটি  কবিতায়  হয়ে  উঠেছে  অসাধারণ মনোগ্রাহী ও সুখপাঠ্য। বেদনার রূপ  কি  একই  রকম  হয় ?  হয়তোবা । নতুবা কবির  বিরহ, স্মৃতি-কাতর  কিছু  কিছু  কবিতা  মনে  হয়  যেন  বেদনা  বা নিজের জীবনেরই প্রতিরূপ। নিশ্চয়  এটা  ভাবা  অন্যায় হবে না। আর এখানেই তো  কবির সার্থকতা । আমাদের  আলোচনায়  এই  গ্রন্থের শেষ থেকেই  শুরু  করতে  চাই। সর্বশেষ  কবিতার নাম– তোমার  বাগানে  ফুল  ফুটিয়ে।

তোমার জন্যে রেখে যাব সুর, তোমার জন্যে গান,

আমার জন্যে রয়ে যাবে অশ্রু, আমার জন্যে  কান্না।

তোমার জন্যে রেখে যাব কবিতা

ভালোবাসার লাজ রঙিম পংক্তিমালা,

আমার জন্য নিয়ে যাব

অন্তমিলহীন অন্ত্যজ শব্দমালা।

(তোমার বাগানে ফুল ফুটিয়ে)

        এই কবিতার অন্তর্নিহিত কষ্টকে  কবি প্রকাশ  করেছেন সুন্দর  করে। কবি  প্রিয়াকে  উজাড়  করে সব দিয়ে  নিঃস্ব  হতে  চান। তোমার  চলে  যাওয়া  মানে কবিতায় কবি প্রিয়াকে  আগলে  রাখতে চান। হৃদয়ের সবটুকু  ভালবাসার মাধুরী  দিয়ে। তিনি  যেন  ধরেই  নিয়েছেন  তার  আকুতিতে প্রিয়তমা ফিরে আসবেই। কবির আরেকটি  কবিতা আজ  মনে হয় তোমাকে  ভালবেসে’ এ কবিতার প্রথম দুটি  চরণেই  কবি  নির্দ্ধিধায়  স্বীকার করেছেন, ভালোবাসা  কিনেছেন দুঃখের  দামে। তাই  চারপাশ ম্লান  হয়ে গেছে  প্রিয়ার চলে  যাবার  কারণে। কবির  কবিতা একদিন এসেছিলে, ভালবেসেছিলে’ কবির মনে স্রোতের মতো ভালবাসার প্লাবন এসেছিল। যদিও ছল করেই  প্রিয়ার আসা যাওয়া, তবুও  কবির  বিশ্বাস সে এসেছিল  এবং  তাকে ভালও বেসেছিল। কিন্তু  কিভাবে অজানা কারনে প্রিয়াকে কবি  ধরে রাখতে পারেননি। মানুষের মনে বিচিত্র  রূপের অবয়ব কবির  কাছে দুর্বোধ্য  লেগেছে। আর তাই  কবিতার শেষ পংক্তিতে জানিয়েছেনঃ–

সেদিনকার প্রতিটি দৃশ্যপট ছিল অনুপম মোহনীয়

আর তোমার রূপের বিভায় উদ্ভাসিত।

একদিন এসেছিলে, আর ভালবেসেছিলে,

মনে আছে আজও মনে আছে।

(একদিন এসেছিলে ভালবেসেছিলে)

         কবি  ভূলতে  পারেন না বলেই  বারংবার  কন্ঠরোধ  হয়ে  যায়  নিরবিচিছন্ন  বেদনায়। আকাশের চাঁদ ছিল’  কবিতায়  কবি  প্রিয়াকে  চাঁদের  চেয়েও  অনুপম  সৌন্দর্যে  দেখেছেন । ফুল, পাখি, নদী  সব আছে  শুধু চাঁদের রূপকে হারিয়ে নেয়া সেই  মানুষটি হারিয়ে  গেছে…।

জানিনা তুমি  আমার  কথা  ভাবো  কিনা’ এই  কবিতায়  কবি  মিথ্যে  সান্ত্বনায়  নিজেকে  ক্ষত-বিক্ষত  করেছেন। প্রশ্নবিদ্ধ  করেছেন  অসংখ্যবার। মেলেনি উত্তর  । পেয়ে  হারাবার  বেদনা ও কষ্ট  কবিকে  তাড়িত  করেছে  । অবশেষে  কবি  প্রশ্নহীন  থেকে  মনকে  প্রবোধ  দিয়েছেন যতদিন এ মন  থাকবে ততদিন এ  মন-বেদনার  শেষ হবে না  জানি । যেখানেই  যাই, যেদিকে তাকাই কবিতায়  কবি  দারুণভাবে  স্মৃতিকাতর। তার জীবনের সকল  আয়োজনে  প্রিয়ার  স্মৃতি তাকে  সতত তাড়িত  করে  ফিরছে  । স্মৃতি  কখনো  সুখের  হয়, কিন্তু  এ  কবিতায়  স্মৃতি  কষ্ঠের  জোছনায়  প্লাবিত  । তবুও  প্রিয়ার  অতীত  স্মৃতি  কবিকে  বেদনা-বিধূর  করে  তুলেছে ।  কতকাল এই  বিষন্ন  শুন্যতায়,  এ  কবিতায়  কবি  হারাবার  বেদনাকে  একদিকে  যেমন  বুকের  ভেতর  লালন  করেছেন  পরম  মমতায়, অন্যদিকে  না  পাবার  অদেখা  কষ্টানুভুতিকে  চারিদিকে  ছড়িয়ে  যেন  বা  হালকা  হতে  চেয়েছেন।

          এই  কাব্যগ্রন্থের  সকল  কবিতার  মাঝেই না দেখা হারানোর যন্ত্রণা যা  কবিকে শুরু  থেকে শেষ  পর্যন্ত  তাড়িত  করেছে  । মনের  গভীরে  সযতনে  ভালোবাসার  মানুষটিকে  স্থান দিয়েছেন যদিও তার বিচেছদ  সান্ত্বনায় মেনে  নিয়েছেন এ এক ধরণের অভিমান  বৈ-তো  আর কিছু  নয়  । কবি  প্রিয়াকে  জোর  করে  ধরে  রাখার  পক্ষপাতী  নন । তাই  ভূল  করে  যে  চলে  গেছে  তার  চলে  যাওয়াকে কবি  নীরবেই  মেনে  নিয়েছেন। ওফেলিয়ার  মতো  যদিও  প্রিয়াকে  তার ভালোবাসার  কথা  মনে করিয়ে  দিয়েছেন। কিন্তু  তাকে  আর  ফিরে  আসার আহ্বান জানাননি। এক বুক  নীরব অভিমানে কবি  যোজন দূরত্বে  অবস্থান  করছেন । মানব  মনের এ  এক  নিগূঢ়  রহস্য  ।

আলোচনার  শেষে  বলা  যায়- এ  কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতায় শুরু  থেকে শেষ পর্যন্ত  সকল  কবিতায়  কাব্যমানে সমৃদ্ধ। পরিশীলিত, হৃদয়গ্রাহী। কবিতাগুলো এক  নিঃশ্বাসে  পড়ে  মুগ্ধ  হবার  মতো। অতিরিক্ত  শব্দ  চয়নের  প্রয়াস নেই ,  বরং  প্রতিটি  কবিতায়  শুরু  থেকে  শেষ  পর্যন্ত  শব্দ  চয়নে, গাঁথনে, সজ্জায়  যথেষ্ট  মেধা ও  মননশীলতার পরিচয়  রেখেছেন।

মানুষের  সারাটি  জীবনই বিচিত্রতায় ভরা।  আর রহস্যময়  মানব মনের  যে না  দেখা  জগত  ভালোবাসার এবং যাকে ঘিরে  কবির  সুখ  দুঃখের বিচরণ,  আর সব  চাওয়া-প্রাপ্তি  পূর্ণতাকে  অবহেলা  করে  প্রিয়ার  চলে  যাওয়া  এ নীরব আকুতি  আর শূন্যতার  ছবি  পরম  দক্ষতায়  কবি  এঁকেছেন  তার  কাব্যে  ।

কবিকে সানন্দ অভিনন্দন জানালাম, এমন সুন্দর শিল্প সুষমামন্ডিত কাব্য আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। জয়তু কবি।

 [প্রকাশকঃ প্রবর্তন প্রকাশন,৭ নং প্রতাপ দাস লেন, সিংটোলা, ঢাকা – ১১০০।পরিবেশকঃ নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ৪৬ বাংলাবাজার ঢাকা – ১১০০।] এছাড়া www.rokomari.com থেকে অনলাইনে সরাসরি বইটি সংগ্রহ করা যাবে।

 

 

Leave a Comment